আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা - কালচারাল শক
আজ থেকে ঠিক ১৬ বছর আগে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের এক যান্ত্রিক পাখিতে চড়ে আমি আমেরিকাতে পিএইচডি করতে এসেছিলাম। আমার জন্য সেটা বহু দিক থেকেই নতুন ব্যাপার, জীবনে প্রথম প্লেনে চড়া, প্রথমবারের মতো মহাসাগর পেরিয়ে অন্য মহাদেশে যাওয়া, অবাক হয়ে পাশের দেশী সহযাত্রীকে প্লেন ছাড়ামাত্র মদ অর্ডার দিয়ে মাতাল হতে দেখা, সদ্য বিয়ে করা বৌকে ৫৮ দিনের মাথায় রেখে আসা। অনেক বড় পরিবর্তন।
এখন শিক্ষকতার কারণে অনেক বাংলাদেশী শিক্ষার্থীকে আমিই আমার গ্রুপে নিয়ে আসি, আর প্রচুর বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর সাথে যোগাযোগ আছে, দেশের ছাড়াও অন্য দেশের শিক্ষার্থীদের পড়াই ক্লাসে। অন্য দেশ থেকে আমেরিকায় পড়তে আসা এই শিক্ষার্থীদের জন্য আমেরিকার সংস্কৃতি, রীতিনীতি এসব অনেক ক্ষেত্রেই পুরোপুরি নতুন। চিরচেনা সবকিছুর চাইতে আলাদা এই পরিবেশে খাপ খাওয়াতে গিয়ে অনেকেই বিশাল সমস্যায় পড়েন। গত এক যুগের বেশি সময় ধরে প্রথমে নিজে দেখে এবং পরে আমার শিক্ষার্থীদের দেখে এই কালচারাল শকগুলোকে ভালো করে দেখা ও জানা হয়েছে। আজকের এই লেখাটা আমেরিকায় আসা শিক্ষার্থীদের জন্য -- কীভাবে এখানকার জীবনে খাপ খাওয়াবেন, তা নিয়ে। এ নিয়ে মোটা একটা বই লেখা সম্ভব, আজকে অল্প কয়েকটা পয়েন্ট তুলে ধরবো।
১) ধন্যবাদের সংস্কৃতি - মার্কিনীরা খুব মিশুক জাতি। পথে ঘাটে অপরিচিত কারো চোখে চোখ পড়লে হাসি দিয়ে বলবে সুপ্রভাত, কেমন আছেন? ভালো তো? লিফটে উঠলেন তো আপনার পরে যিনি ঢুকছেন,তিনি আপনাকে দেখে বলবেন এগুলা, আবার বেরুবার সময় হ্যাভ আ নাইস ডে বলে বেরুবেন। তাছাড়া সবকিছুতেই ধন্যবাদ দেয়ার চল। এই ব্যাপারগুলা আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে খুব বেশি নাই। ফলে প্রথম প্রথম অবাক হতে পারেন অপরিচিত কেউ হাত নাড়ে কেনো, অথবা আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসছে কেনো, সেটা নিয়ে। আবার দোকানদার আপনার পয়সা দিয়ে কেনা জিনিষ হাতে দিলে আপনি কেনো থ্যাংকু বলবেন, সেটা নিয়েও খাবি খেতে পারেন। সহজ সমাধান, প্রতিটি বাক্যেই প্লিজ বলার অভ্যাস করুন, আর কেউ কিছু দিলে, জানালে, তাকে অকুণ্ঠ্য ধন্যবাদ দিতে থাকুন থ্যাংক ইউ বলে। আর চলার পথে কারো চোখে চোখ পড়লে হাই বলার অভ্যাস করুন। কেউ এটা বলার মানে আবার ধরে নিবেন না সে খাতির জমাতে চায়। হোমওয়ার্ক/পরীক্ষার চাপে ভর্তা হয়ে গেলেও গোমড়া মুখে প্যাঁচার মতো চেহারা করে না থেকে হাসি মুখ করে থাকার অভ্যাস করুন।
২) প্যাঁচানো বাদ দেয়া - কথাবার্তা সরাসরি বলুন ও লিখুন। ছোটবেলায় পিতার কাছে টাকা চাহিয়া পত্র লেখার যে ভনিতা অভ্যাস হয়ে গেছে, সেটা বাদ দেন। গেট টু দ্য পয়েন্ট। অতি বিনয় অতি ভনিতা করতে থাকলে মূল বিষয় বাদ পড়ে যায়। তার উপরে জিআরই টোফেল থেকে যেসব দুর্বোধ্য শব্দ শিখেছিলেন, সেগুলা দ্রুত ভুলে যান, ঐগুলা আমেরিকাতে কেউ কথ্য ভাষায় ব্যবহার করে না। ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করুন, কম্পাউন্ড বা কমপ্লেক্স বাক্য ব্যবহার করা কথায় বা লেখায় দুই ক্ষেত্রেই বাদ দেন।
৩) দরজা -- দরজা ধরে রাখার ব্যাপারে আমেরিকার লোকজনের সৌজন্য রীতিমতো লিজেন্ডারি। ব্যাখ্যা করে বলি, ধরা যাক আপনি কোনো দোকানে দরজা খুলে ঢুকবেন। আপনার পিছনে একজন আসছে। এখানকার রীতি হলো ভদ্রতা করে দরজাটা পিছনের লোকের জন্য খুলে ধরে রাখতে হবে। বড় শহরে হয়তো কেউ এটা কেয়ার করে না, কিন্তু অধিকাংশ কলেজ টাউন ছোট শহরে, যেখানে দরজা ধরে রাখার ভদ্রতাটা সবাই আশা করে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে আপনি নিজেই চাপে পড়বেন, আপনি হয়তো ১০০ ফুট দূরে, কিন্তু আপনার সামনের ভদ্রলোক দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে, আপনাকে তাই হন্তদন্ত হয়ে হবে যেতে। আর এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে ভুলবেন না।
৪) চোখে চোখ রাখা -- কথা বলার সময়ে চোখে চোখ রেখে কথা বলাটা বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে একটা বিশাল ট্যাবু। "কত্ত বড় বেয়াদব, চোখ তুলে কথা বলে" এই ব্যাপারটা ছোটবেলা থেকে মাথার ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়, ফলে মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে টিচারের বা বসের সাথে কথা বলাটাই বাংলাদেশের রীতি। আমেরিকাতে এর পুরাপুরি উল্টা। কারো সাথে কথা বলার সময়ে যদি চোখে চোখ রেখে কথা না বলেন, সবাই সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাবে, ধরে নিবে আপনার মাথায় কোনো সমস্যা আছে বা চরম লাজুক অসামাজিক রোগী। কাজেই চোখে চোখ রেখে কথা বলুন মাথা উঁচু করে, সেটা বেয়াদবী ধরবে না কেউ। আবার অন্য দিকও আছে, কারো দিকে অদরকারে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকাটা সন্দেহজনক, সেটা ভুলেও করবেন না।
৫) মিশুক কাউকে ভুল বোঝা -- এই পয়েন্টটা বিশেষ করে ছেলেদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যত্র কেউ হাসিমুখে আপনার সাথে কথা বলছে বা হাই বলছে তার মানে কিন্তু এই না যে সে আপনার ব্যাপারে আগ্রহী। কাজেই কেউ আপনার সাথে ভালো করে মিশলে তার ব্যাপারে রোমান্টিক চিন্তা শুরু করে দিলে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করলে বিশাল সমস্যায় পড়বেন, বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের ব্যাপারে ছাড় দেয়া হবে না, জেলে যেতে হবে বেচাল কাজ করলে।
৬) আগের পয়েন্টের সূত্র ধরে আরেকটা ব্যাপারে সাবধান করি -- বাংলাদেশে টিউশনির শিক্ষকেরা অহরহ ছাত্রীদের সাথে রোমান্টিক সম্পর্কে জড়ান, এই ব্যাপারটাকে ডাল ভাত ধরা হয়। হুমায়ুন আহমেদের গল্পে প্রায়ই গোবেচারা গৃহশিক্ষকের কিংবা কলেজের শিক্ষকদের দেখা যায় ছাত্রীর প্রেমে পড়তে। আপনারা যারা উচ্চশিক্ষার্থে আমেরিকায় আসছেন, তারা অনেকেই টিচিং এসিস্টেন্ট হিসাবে আন্ডারগ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীদের ল্যাব কিংবা ক্লাসে পড়াবেন। ভুলেও দেশের মতো করে ক্লাসের শিক্ষার্থীদের দিকে রোমান্টিক নজর দিবেন না। শিক্ষার্থীর কাছ থেকে আগ্রহ আসলেও না। আমেরিকার শিক্ষাক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা প্রচন্ড রকমের আন এথিকাল ধরা হয়, এবং এটাকে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট ধরা হয়, দুই পক্ষের সম্মতি থাকলেও এটা বে আইনি যতদিন আপনি কারো শিক্ষক থাকবেন। আবার কোনো কোনো স্টেটে এটা কঠিন রকমের অপরাধ -- আমার রাজ্য অ্যালাবামাতে ১৯ বছরের কম বয়সী কোনো শিক্ষার্থীর সাথে রোমান্টিক বা অন্য সম্পর্ক বেশিদূর গড়ালে দীর্ঘ মেয়াদী জেলের সুব্যবস্থা আছে। কাজেই টিচিং এসিস্টেন্ট হিসাবে আপনার কাজ কেবলই টিচিং, সেটা খেয়াল রাখুন।
৭) পার্সোনাল স্পেস -- আমেরিকায় পার্সোনাল স্পেসের ব্যাপারটা অনেকটা অলিখিত। যে কোনো ব্যক্তির গা থেকে চার দিকে ২ ফুট দূরত্ব পর্যন্ত এলাকাকে তার পার্সোনাল স্পেস বা ব্যক্তিগত এলাকা ধরা হয়। কারো সাথে কথা বলার সময়ে এতটুকু দূরত্ব বজায় রাখা দরকার, নিতান্ত আপনজন না হলে কারো এতোটা কাছে ঘেঁষতে হয় না। একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা বাংলাদেশে অতো খারাপ হয়তো ধরা হয়না, বিশেষত বন্ধুদের মাঝে। কিন্তু যত ঘনিষ্ঠ বন্ধুই হোক না কেনো, পার্সোনাল স্পেসের মধ্যে কেউ ঢুকে গেলে সেই ব্যক্তি ব্যাপক অস্বস্তিতে পড়ে যায়। কাজেই একটু খেয়াল রাখুন।
৮) এথিক্স - সবশেষে বলবো এথিক্স নিয়ে। এই ব্যাপারটা আসলে কেবল বাংলাদেশের না, আমেরিকার বাইরে বিশেষ করে এশিয়ার প্রায় সব দেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেই সমস্যার সৃষ্টি করে। কোর্সওয়ার্কে এসাইনমেন্ট কপি করা, একজনে লিখলে সেটাকে বাকি সবাই চোথা মেরে দেয়া, অথবা বই থেকে হুবুহু টুকে, ইন্টারনেট থেকে কপিপেস্ট করে দেয়া -- পরীক্ষার সময়ে পাশের জনের খাতায় উঁকি দেয়া, এইগুলা যে চরম গর্হিত কাজ, সেটা খুব বেশি কেউ মনে হয় ভাবে না। সমস্যাটা হলো আমেরিকার শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ করে ইউনিভার্সিটিগুলাতে এসবের ক্ষেত্রে প্রচন্ড কড়া অনার কোড আছে। নকল করে এসাইনমেন্ট জমা দিলে ধরা খাবেন নিশ্চিত, কারণ নকল ধরার সফটোয়ার ব্যবহার করা হয়। (যেমন Turnitin)। অধিকাংশ ইউনিভার্সিটিতে প্রথমবার ধরা খেলে ঐ এসাইনমেন্টে শূণ্য পাবেন, ওয়ার্নিং দেয়ার পরে আবারও যদি ধরা পড়েন একই কোর্সে, তাহলে কোর্সে সরাসরি এফ গ্রেড তো পাবেনই, তার উপরে এটা ডিনের কাছে রিপোর্ট হবে, বহিষ্কার হয়ে যাবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এমনকি কোনো জায়গা থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিলে সূত্র উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক, আর কোন অংশ উদ্ধৃতি সেটা স্পষ্ট করে উল্লেখ করতে হবে। যেকোনো কিছু ইন্টারনেট থেকে বা বই থেকে কপি না করে নিজের ভাষায় লিখতে হবে। আর যেসব এসাইনমেন্টে একা কাজ করার কথা, সেখানে নিজের হোমওয়ার্ক নিজেকেই করতে হবে।
--
কালচারাল শকের নানা বিষয় নিয়ে মহাকাব্য লেখা চলে। যারা প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে আসবেন, তাঁদের জন্য এটা খুব কঠিন একটা সময়। একটু বুঝে শুনে চললে, স্থানীয় রীতিনীতির সাথে মানিয়ে চললে খুব সহজেই মানিয়ে নিতে পারবেন। উচ্চশিক্ষার জগতে আপনাদের পদযাত্রা শুভ হোক।
লিখেছেনঃ ড. রাগিব হাসান
Dr. Ragib Hasan
Associate Professor,
Dept. of Computer and Information Sciences,
University of Alabama at Birmingham
He also leads the SECuRE and Trustworthy Computing Lab (SECRETLab).
And the founder of Shikkhok.com
আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে লেখকের আরো একটি চমৎকার লিখাঃ আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা ! ফান্ডিং না পেলে কীভাবে পড়বেন?
===========================================================================================
যারা জি,আর,ই ভারবাল নিয়ে চিন্তিত তারা ভিডিও গুলো দেখতে পারেনঃ জি ,আর, ই হাই ফ্রিকুয়েন্সি ওয়ার্ড
জি,আর,ই জিওমেট্রি পার্ট নিয়ে যারা চিন্তিতঃ জিওমেট্রি ইন ওয়ান প্লে লিস্ট
You would also like to know: I20 is the most important document that you will need for a student visa in the USA.
Related Posts
- আমি কিভাবে প্লেনের টিকেটে ২৫ হাজার টাকা সেভ করলাম
- উদ্দেশ্য - Permanent Residence (PR)
- কানাডিয়ান ম্যাপল দেখবো বলে! পর্বঃ ৪
- কানাডিয়ান ম্যাপল দেখবো বলে! পর্বঃ ৩
- কানাডিয়ান ম্যাপল দেখবো বলে! পর্বঃ ২
Recent Posts
- GRE verbal reasoning effective time management strategy
- Should you take home based GRE test?
- IELTS প্রবচন পর্ব - ০৮
- উচ্চশিক্ষায় সিজিপিএ বনাম জিআরই
- জি আর ই সম্পর্কে জানা অজানার কিছু মজার ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
Categories
- Interview
- Tutorial
- Standard Test
- Documents
- Decision Making
- Preparation
- Funding
- University Selection
- Living Abroad
- Others
- Scholarship
- Journals
- Application
- Research
- Life in USA
- International Tour
- Job
Tags
- USA
- Speaking
- IELTS
- GRE Math
- TOEFL
- GRE
- Europe
- SOP
- Sweden
- Canada
- video
- Research
- Mechanical
- Texas
- Miscellaneous
- Passport
- Resume
- CV
- Letter of Recommendation
- GMAT
- Germany
- Japan
- University Ranking
- Fulbright
- SAT
- publications
- Professor
- Masters
- PhD
- Back Bencher
- Low CGPA
- Australia
- Listening
- Study Plan
- Scholarship Application Bangladesh
- Commonwealth Shared Scholarship
- Merit Scholarships
- How to apply for commonwealth scholarship
- Chevening scholarship bangladesh
- Scholarship for bangladeshi students
- Advice
- Ethics
- higher study prep gre test prep
- VISA
- Wi-Fi
- Business graduate
- Air ticket
- Switzerland
- MBBS
- Medical
- Learning english
- Statement of Purpose
- GRE Verbal